চ্যাটজিপিটি-সহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক টুল ব্যবহারে মানুষের চিন্তাশক্তি ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে—এমনই চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান এমআইটির (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। এমআইটির মিডিয়া ল্যাব পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত লেখালেখির কাজে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করছেন, তাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক সক্রিয়তা কমে যাচ্ছে, যা তাদের মননশীলতা ও সৃজনশীলতাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
চার মাসব্যাপী গবেষণাটিতে অংশ নেন ১৮ থেকে ৩৯ বছর বয়সী ৫৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক। তাদের তিনটি দলে ভাগ করা হয়—প্রথম দল চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে রচনা লেখে, দ্বিতীয় দল গুগল সার্চ ব্যবহার করে এবং তৃতীয় দল কোনো প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়াই নিজ চিন্তায় লেখে। গবেষণার চতুর্থ মাসে কিছু অংশগ্রহণকারীর ক্ষেত্রে টুল ব্যবহারে পরিবর্তন আনা হয়—কেউ চ্যাটজিপিটি ব্যবহার শুরু করে, আবার কেউ বন্ধ করে দেয়। পুরো প্রক্রিয়ায় তাদের মস্তিষ্কে EEG (Electroencephalogram) যন্ত্র সংযুক্ত ছিল, যা মস্তিষ্কের তরঙ্গ ও সংযোগ পর্যবেক্ষণ করে।
ফলাফল ছিল বিস্ময়কর ও উদ্বেগজনক। দেখা যায়, যারা চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করছিল, তাদের মস্তিষ্কে নিউরাল সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং আলফা ও বিটা তরঙ্গের কার্যক্রম কমে যাচ্ছে। এদের রচনা লেখায় আগ্রহও কমে আসে। তুলনায়, গুগল ব্যবহারকারীদের মস্তিষ্কে মাঝারি স্তরের সক্রিয়তা দেখা যায়, আর একমাত্র প্রযুক্তিবিহীন দলের ছিল সবচেয়ে দৃঢ় ও সক্রিয় মস্তিষ্ক।
এই ধারা নতুন নয়। এর আগেও এমআইটির একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, চ্যাটজিপিটির নিয়মিত ব্যবহার মানুষের মধ্যে নির্ভরতা তৈরি করে, যা নেশাজনিত আচরণ বা প্রযুক্তি-নির্ভর বিচ্ছেদ উপসর্গে পরিণত হয়। কার্নেগি মেলন ও মাইক্রোসফটের যৌথ গবেষণাও বলছে, চ্যাটবটের অতিরিক্ত ব্যবহার ব্যবহারকারীদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে একাধিক গবেষণার ভিত্তিতে বলা হয়, চ্যাটজিপিটিসহ এআই প্রযুক্তি মানুষের ভাবনার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। এমনকি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর একজন সাংবাদিকও স্বীকার করেন, চ্যাটজিপিটি অতিরিক্ত ব্যবহার করে তিনি নিজের বিশ্লেষণী সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও বাড়ছে উদ্বেগ। প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট Futurism-এর তথ্যমতে, অনেক ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটির প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছেন যে তারা একপ্রকার মানসিক বিভ্রমে ভুগছেন—এমনকি অনেকে নিজেদের ওষুধ খাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন, কারণ চ্যাটজিপিটি তা করতে বলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে ওপেনএআই-এর একটি বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা জানি, মানুষ বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে, এবং আমরা বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। আমরা চাই, এটি যেন ক্ষতিকর উপদেশ না দেয় এবং সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে আরও সচেতনভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়—সে লক্ষ্যে কাজ করছি।”
সব মিলিয়ে গবেষকেরা বলছেন, চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি আমাদের মস্তিষ্ক ও মানসিক স্বাস্থ্যে কী প্রভাব ফেলছে—তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। কিন্তু আশঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে অনেকখানি। এরপরও করপোরেট বিশ্ব যেন এই প্রযুক্তিকে ছড়িয়ে দিতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই।
মন্তব্য
এই নিবন্ধটি জন্য কোন মন্তব্য নেই.